দহন

হাতেখড়ি হয়েছিল সেই ছেলেবেলায়। এখনও স্পষ্ট মনে আছে।
আগের দিন বিকেলে এক ঘুষিতে পাশের বাড়ির বেলায়েতের নাক ভেঙে বাড়ির পিছনে কবরখানায় লুকিয়েছিল সে। কিছুক্ষণ পর মশারা সদলবলে হামলে পড়ল তার উপর। আরও একটু পরে হাঁসেরা প্যাক-প্যাক করে ডাকতে ডাকতে দলবেঁধে ফিরতে শুরু করল যে যার বাড়িতে। অথচ তার বাড়ি ফেরার জো নেই। এতক্ষণে মা নির্ঘাৎ জেনে গেছে বেলায়েতের নাক ভাঙার কথা, বসে রয়েছে হাতে পাকা কঞ্চি নিয়ে, একবার ধরতে পারলে গায়ের হাড়-মাংস আলাদা করবে আজ। কবরখানার পুরোটা জুড়েই বাঁশবন। তারই ফাঁকে ফাঁকে উড়ে বেড়াচ্ছে জোনাকিপোকা। একবার জ্বলছে, একবার নিভছে। জ্বলতে নিভতে কয়েকটা চলে এসেছিল খুব কাছে, হাত বাড়িয়ে কয়েকটা খপাখপ ধরেও ফেলেছে সে এরইমধ্যে। এখন সেগুলো হাতের মুঠোয় বন্দী। এমন সময় লণ্ঠন হাতে কাউকে এগিয়ে আসতে দেখল কবরখানার দিকে। লণ্ঠনের অপর্যাপ্ত আলোতেও আবছা নারীমূর্তিটিকে চিনতে একটুও অসুবিধা হলো না তার। ও যে তার মা! মা’কে দেখে একবার ভেবেছিল ঝেড়ে দৌড় দেবে, পরক্ষণেই সিদ্ধান্ত বদলাল। দেখা যাক না কি হয় শেষ পর্যন্ত! একসময় লণ্ঠন এগিয়ে এলো খুব কাছে, মা’র গলা শোনা গেল, ‘বাজান, আমার কাচে আয় বাজান। আমি তোরে কিচ্চু কমুনা। আয় বাজান। এদিকে আয় একবার।’
মা’কে খুব বিশ্বাস করে সে। একবার যখন মা বলেছে কিছু বলবে না তখন আর কোন ভয় নেই। সে জানে, মা তাকে একটুও মারবে না আজ। কবরখানা থেকে তাই বেরিয়ে এলো, ধরা দিল সে মা’র কাছে। সে রাতে সত্যিই মা তাকে কিছু বললো না। বেলায়েতের নাক ভেঙেছে কিনা তাও জিজ্ঞেস করলনা একটিবারও।
রাতটা কেটেছিল ভালো। কিন্তু পরদিন বাঁধল গোল। সাতসকালে কান ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে গেল মা তাকে গ্রামের গঙ্গামতী স্কুলে। হারু মাষ্টার হলেন স্কুলের হেড, ঠেলেঠুলে তাঁর ঘরে ঢুকিয়ে তবেই কান ছাড়ল মা। হারু মাষ্টারকে বললো, ‘ছার, আমার পোলারে আপনার ইসকুলে ভত্তি কইরা নেন। তারে নিয়া আমি আর পারিনে। তার বাপ মইরা বাচ্চে, আমারে তো মাইরা গ্যাছে এক্কেরে।'
হারু মাষ্টার চশমার নিচ দিয়ে তাকালেন একবার ছেলেটির দিকে, ‘কিরে, নাম কি তোর?'
‘রইচ।’ বললো ছেলেটি।
‘বয়স কত?’
‘সাত হবে।’ বললো মা।   
‘শিশুক্লাসে গিয়ে বয়।’ বললেন হারু মাষ্টার, তারপর মন দিলেন নিজের কাজে।
স্কুলের সামনে ছোট্ট এক চিলতে খেলার মাঠ। এক কোণায় খুব বড় একটা শিশুগাছ। শিশুক্লাস বসে সেই গাছটার তলায়। সেখানে গিয়ে বসল রইচ, খেজুরপাতার চাটাইতে। মাষ্টারসাহেব সুর করে পড়াচ্ছিলেন স্বরে অ, স্বরে আ। রইচ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিল তাঁর মুখের দিকে, আর তার মন পড়ে ছিল হেডমাষ্টারসাহেবের ঘরে। কি সুন্দর একটা জিনিস পড়ে রয়েছে সেখানে তাঁর টেবিলের উপর! স্বচ্ছ চকচকে, কি সুন্দর গোল, কাচের তৈরি মনে হয় জিনিসটা, কিছু কাগজ-পত্র রয়েছে তার নিচে। রইচের মনে হলো, যেভাবেই হোক ঐ জিনিসটা তার চা’ই চাই। তক্কেতক্কে ছিল সবসময়, এক সময় মওকাও মিলে গেল একটা। হারু মাষ্টার গিয়েছিলেন টয়লেটে, সেই সুযোগে বিড়ালের মতো নিঃশব্দে তাঁর ঘরে ঢুকল রইচ, এক পলকে পেপারওয়েটটা টেবিলের উপর থেকে হাতে তুলে নিল, সোজা চালান করে দিল হাফপ্যান্টের পকেটে। ব্যাস হয়ে গেল হাতেখড়ি। চুরিবিদ্যার হাতেখড়ি। সেই থেকে শুরু।
সেবার অবশ্য চুরি করা জিনিসটা শেষ পর্যন্ত হজম করতে পারেনি রইচ। দু’দিন যেতে না যেতেই কিভাবে কিভাবে যেন ঘটনা হারু মাষ্টারের কান অব্দি পৌঁছে গিয়েছিল। হারু মাষ্টার একদিন তাকে তাঁর ঘরে ডেকে নিয়ে দরজা আঁটকালেন, পিঠের চামড়া তুললেন শপাং শপাং বেতের বাড়িতে। যা লাগা লেগেছিল সেদিন!
যে চুরি করে, সে ধরাও পড়ে। ভাত খেতে বসলে তো দু’টো-চারটে ছড়াবেই! এই জীবনে রইচ চুরি করেছে অসংখ্যবার। কিন্তু সে তুলনায় ধরা পড়েছে খুব কম। মনে আছে একদিনের কথা। সতের-আঠারো বয়স হবে তখন তার, মা মরেছে সবে বছর তিনেক হয়েছে। ওদের গ্রামের জামেল মোড়লের বাড়িতে মাঝরাতে ঢুকেছিল রইচ। হাতের কাজ শেষ, বের হতে যাবে এমন সময় পা লেগে ঝনঝন করে উঠল কাঁসার থালা। শালা পড়বি না পড় মালির ঘাড়ে! জামেল মোড়ল চোর চোর বলে হেই ধেই করে উঠল। সন্ধ্যারাতে এক পশলা বৃষ্টি হয়েছিল, এতক্ষণ গোলার তলে ওদের পোষা কুকুরটা ঘুমোচ্ছিল কুণ্ডলী পাকিয়ে, সেও তারস্বরে ঘেউঘেউ করতে লাগল। মোড়লবাড়ির মাস-কাবারে চাকরটা হঠাৎ-ভাঙা ঘুমের ঘোরে কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না প্রথমে, পাগলের মতো এদিক-ওদিক দৌড়াদৌড়ি করতে করতে এক সময় জাপটে ধরে ফেলল রইচকে, সজোরে কিল ঘুষি চালাতে লাগল অন্ধকারের মধ্যেই। শালা চাষার ব্যাটা চাষা। হাত তো নয় যেন লোহার ডাণ্ডা! একাই মেরে কাহিল করে ফেলল রইচকে। শেষদিকে এসে তলপেটে যখন সজোরে একটা লাথি কষল তখন দূরে ছিটকে পড়ল রইচ। তাকে পিঠমোড়া করে বেঁধে রাখা হলো উঠোনে। মোড়লবাড়ির চিৎকার চেঁচামেচিতে আশেপাশের বাড়ির লোকজনও ততক্ষণে এসে হাজির। সবাই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে। কি লজ্জ্বা! রইচ যেন মরে যাচ্ছিল। মনে মনে বলছিল, ছাড়া পেলে এ গ্রাম ছেড়ে সে চলে যাবে দূরে কোথাও। এ মুখ আর কাউকে দেখাবে না সে।
সেদিন ছাড়া পেয়ে রেলগাড়িতে চেপে বসেছিল রইচ। নেমেছিল কমলাপুর স্টেশনে। অবশ্য আসতে আসতে একটা দুঃসাহসিক কাজ করেছিল। ট্রেনে ভিড়ের মধ্যে একজনের পকেট থেকে মানিব্যাগ তুলে নিয়েছিল রইচ। হাজারখানেক টাকা ছিল সেখানে, ট্রেনের টয়লেটে গিয়ে টাকাটা কোমরে গুঁজে মানিব্যাগটা ফেলে দিয়েছিল সে টয়লেটের মলমূত্র পড়ার রাস্তা দিয়ে। আগে কখনো এই কাজটা করেনি সে। তাই কাজটা সফলভাবে শেষ করতে পেরে নিজেকে কেমন সার্কাসের টগবগে ঘোড়া মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যেকোন বাঁধা সে টপকে যেতে পারবে লেজ উঁচিয়ে, তা সে যত বড়ই হোক না কেন।
ট্রেন থেকে নেমে কমলাপুর বস্তিতে অনেক ঘোরাঘুরি শেষে দর-দস্তুর করে একটা কামরা ভাড়া নিয়েছিল রইচ। পকেটমারা টাকা থেকে সেই কামরা ভাড়ার অগ্রিম দেওয়ার পরেও হাতে অবশিষ্ট ছিল শ’পাঁচেক। এই টাকা ক’টা শেষ হওয়ার আগেই আবার রোজগার করতে হবে। রইচ ভীষণ চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল।
কিছু তিতে অভিজ্ঞতা আছে রইচের। চুরি করা ভারী সহজ একটা কাজ! কিন্তু চুরি করার পর চোরাই মাল বেচা-বিক্রিতে রয়েছে রাজ্যের হ্যাপা। শুধু শুধু ঐ ঝামেলায় যায় কে! এখানে বাসে ভিড়, ট্রেনে ভিড়। সর্বত্র শুধু ভিড় আর ভিড়। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য মানুষ দৌড়াচ্ছে হন্যে হয়ে, নিজের পকেটের দিকে কারো নজর নেই। সুযোগ বুঝে শুধু দু’আঙুল পুরে দিতে পারলেই হলো। এই শহরে এসে রইচের মনে হয়েছিল এখানে চুরি করার চেয়ে পকেটমারাটাই বেশি নিরাপদ। চুরি বাদ দিয়ে তাই সে এ কাজটাই করতে লাগল মন দিয়ে। তা, কামাই-রোজগার বেশ ভালোই হচ্ছিল রইচের। বড় কোন বিপদ-আপদেও পড়তে হয়নি এর মধ্যে। এভাবেই কেটে গেল বছর তিনেক।
রইচের বেশ উন্নতি হয়েছে। এখন আর সব দিন কাজে বেরোয় না। একা মানুষ, এত কামাই-রোজগার করে কি হবে! এখন সপ্তাহে দু’একদিন সে চকচকে জামা পরে, মাথায় সুগন্ধি তেল মেখে পরিপাটি করে চুলে সিঁথি কাটে। বিকেলে সিনেমা দেখতে যায়। ঠিক এমন একটা সময়ে তার জীবনে এলো সে। অনেকদিন ধরে দেখছে রইচ মেয়েটাকে। এই বস্তিতেই, ওর খুপরির তিন-চারটে পাশের একটা খুপরিতে থাকে, মা’র সাথে। ওর মা ওকে জরিনা বলে ডাকে। জরিনার গায়ের রং ময়লা, কিন্তু ওর চেহারায় কি যেন একটা আছে। চোখ দু'টো একদম কদমফুলের মতো। শরীরের গড়নটাও সেইরকম, টানটান। রইচকে দেখলে হাসে। রইচকে টানে।
একদিন সকালে কাজে বেরোনোর সময় খুব করে সেন্ট-টেন্ট মেখে জরিনাদের খুপরির মধ্যে উঁকি দিল রইচ, শব্দ করে কাশল দু’বার। সাড়া দিল জরিনার মা, ‘রইচমিয়ার কি ঠাণ্ডায় ধরছে?’
ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল রইচ, ‘জরিনারে দেহি না খালা।’
‘তারে আবার কি দরকার?’ খালার গলায় রসিকতা।
‘না মানে, দেহি নাতো, তাই জিগাইলাম আর কি!’ থতমত খেয়ে উত্তর দিল রইচ।
‘ভিত্‌রে আহো। বও।’ খালা ডাকল।
রইচ খুপরির ভিতরে গিয়ে বসল।
‘জরিনারে পাঠাইছি পান আনতে।’ বললো খালা।
‘ও।’ ঠোঁট দু’টো গোল করল রইচ। খুপরির মধ্যে এদিক ওদিক তাকাল। এই রকম একটা দোযখের মধ্যে থাকে জরিনা! মেয়েটার জন্য কষ্ট হচ্ছিল রইচের। ‘মাইয়াতো ডাঙ্গর হইছে। বিয়া-থা দিবা না?’ জানতে চাইল সে।
‘হ, বিয়া তো দিমু। কিন্তুক ভালো পোলা তো পাইনা।’ খালা বললো, গলায় হাপিত্যেশ।
'কি যে কও না খালা! কত ভালো পোলা রইছে আশেপাশে।' নিজের দিকে তাকাল, একটা বিশেষ ইঙ্গিত দিল রইচ।
খালা বুঝল কিনা কে জানে, জিজ্ঞাসা করল, ‘রইচমিয়া, তুমি কি কাম কর? এত ফিটফাট থাহো সবসময়!’
‘হাতের কাম করি।’ বললো রইচ, একটু হাসল। হাতে পান নিয়ে জরিনাকে আসতে দেখল তখন, দেখেই তড়াক করে লাফিয়ে উঠল বসা থেকে, সোজা হাঁটা ধরল দরজার দিকে। পিছনে শুনতে পেল খালার গলা, ‘রইচমিয়া, যাও কই? একটা পান মুখে দিয়া যাও।’
কে খায় কার পান! পড়িমড়ি করে চিকন দরজা গ’লিয়ে বেরোতে গিয়ে জরিনার ভরাট শরীরের সাথে ধাক্কা খেল রইচ, তাতেই বিদ্যুৎ খেলে গেল যেন তার পুরুষ শরীরে। লম্বা পা ফেলে হাঁটছিল, খানিকটা এগিয়ে গিয়ে পিছনে ফিরে তাকাল একবার। জরিনা তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে। মুখে সেই হাসি। বুকের ছাতি ধরে কেউ যেন হ্যাচকা টান মারল একটা!
এর কিছুদিন বাদে জরিনার সাথে রইচের বিয়ে হয়েছিল। মেয়েটার বুদ্ধি আছে বটে! বাসররাতে কায়দা করে পেটের কথা বের করে নিয়েছিল রইচের মুখ দিয়ে। পাশে শুয়ে ঘ্যানর ঘ্যানর করে রইচের মাথা ধরাচ্ছিল। একসময় রইচ’ই বলতে বাধ্য হয়েছিল কি তার সেই বিশেষ ‘হাতের কাম’। স্বামী পকেটমার শুনে মন খারাপ করে শুয়ে ছিল জরিনা। শেষরাতে কাঁদো-কাঁদো গলায় বলেছিল, ‘তোমার পায়ে পড়ি। তুমি এই কাম আর কইরো না গো।’
রইচ চুপ করে ছিল সেদিন। এতদিনে নিজের পেশাটার উপর তার মায়া পড়ে গেছে। এখন এটা তার নেশাও। সারক্ষণ যেন আঙুল দু’টো চুলকোয়। এটাকে ছাড়ার কথা সে ভাবতে পারেনা। মরে গেলেও না।
সব জেনেশুনেও জরিনা রইচকে ছেড়ে যায়নি। অনিচ্ছাসত্ত্বেও এক সময় মেনে নিয়েছিল সবকিছু। বছরবাদে তাদের একটা মেয়ে হয়েছিল। রইচের গায়ের রং শ্যামলা, জরিনার গায়ের রং কালো। অথচ মেয়েটা পেয়েছিল দুধে-আলতা গায়ের রং। গোল মুখটাতে যেন অবিকল চাঁদের মুখ বসানো। যেদিন আসমান থেকে ওদের খুপরির ঘরটাতে নেমে এসেছিল চাঁদটা, সেদিন অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল রইচ সেই চাঁদের দিকে। মেয়ের নিষ্পাপ মুখটা দেখে সেদিন ভিতরটা কেমন গ’লে গিয়েছিল তার। বউও যেন পড়তে পারছিল তার ভিতরটা, সুযোগ বুঝে মোক্ষম সময়ে কোপ বসাতে ভুল করলনা একচুলও, ‘ওগো, মাইয়ার গা ছুঁইয়া বলো, তুমি আর ঐ কাম করবা না কোনদিন।’
সেই মেয়ের বয়স এখন তিন বছর। বউয়ের কথামতো সেদিন মেয়ের গা ছুঁয়ে কথা দেয়নি রইচ। কিন্তু খোদার নামে দিব্যি দিয়ে বলতে পারবে, এই তিন বছরে সে একদিনও কারও পকেটে হাত দেয়নি। কারোর কিচ্ছু চুরি করেনি কোনদিন। ভোর থেকে মাঝরাত পর্যন্ত ফ্লাস্কে করে এই শহরের রাস্তায় রাস্তায় চা বিক্রি করেছে। চলতিপথে কত টাকা রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখেছে কতদিন, কোনদিন ভুলেও ছুঁয়ে দ্যাখেনি সেগুলো। কিন্তু আজ! কোথা থেকে যে কি হয়ে গেল! লোভ নামের যে ঘুনপোকাটা এতদিন মনের গহীনে কোন এক হিমঘরে ঘুমিয়েছিল কুম্ভকর্ণের মতো, আজ সহসা যেন তার ঘুম ভাঙল। ক্ষুধার্ত কুম্ভকর্ণ ঘুম থেকে উঠেই গোগ্রাসে গিলে ফেলল যেটা সামনে পেল সেটাই!
তখন সকাল দশটার মতো বাজে। রাস্তার মোড়ের সিএনজি পাম্পটার কোণে বসে চা বিক্রি করছিল রইচ। এমন সময় খুব জোরে একটা শব্দ হলো। একটা ট্রাক চলে গেল জোরে হর্ণ বাজিয়ে সোজা দক্ষিণ দিকে। আঠারো-উনিশ বছরের একটা ছেলে ছিটকে পড়ল রাস্তার এপাশটায়। মুহূর্তেই রক্তের নদী বইতে লাগল রাস্তার বুকে। অন্যদের সাথে রইচও ছুটে গেল রাস্তায় পড়ে থাকা ছেলেটার দিকে, ধরাধরি করে আহত শরীরটা নিয়ে এলো রাস্তার পাশে। তখনই ঘটল ঘটনাটা। ছেলেটার পকেট থেকে বেরিয়ে এলো একটা মোবাইল, দেখেই মনে হলো অনেক দামী, রইচের হাতে ওটা যেন জড়িয়ে গেল। কতদিন কত সাহেবকে দেখেছে সে তার কাছ থেকে চা খাওয়ার সময় এ রকম মোবাইলে টেপাটিপি করতে। এরকম একটা মোবাইল কেনার শখ তার বহুদিনের। কেনা হয়নি। এখন আর সে রকম সুদিন নেই রইচের। কষ্ট করে টাকা আয় করে। বলতে গেলে দিন আনে দিন খায়। এত দামী মোবাইল সে কিনবে কোত্থেকে! আজ যখন এরকম একটা জিনিস নিজের করে নেওয়ার সুযোগ হাতের মধ্যে এসে পড়েছে, তখন কিভাবে এ সুযোগ হেলায় হারানো চলে! আড়চোখে একবার আশেপাশে দেখল রইচ। না, কেউ খেয়াল করেনি ব্যাপারটা। এক পলকে মোবাইলটা নিজের প্যান্টের পকেটে রেখে দিল। তারপর চলে গেল একটু দূরে। অতীত অভিজ্ঞতা বলে চুরি করা মাল নিয়ে স্পটে থাকতে নেই। রইচ তাই ডানে-বায়ে না তাকিয়ে হাঁটা ধরল একদিকে।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। এর মধ্যে কয়েক বার মোবাইলটা বেজে উঠেছে। রইচ এটুকু অন্তত বুঝতে পেরেছে যে ফোন এসেছে। কিন্তু রইচ ধরেনি। ধরবে কি করে, সে তো ফোন ধরতে জানে না! সন্ধ্যার একটু আগে পার্কে বিশ-বাইশ বছরের একজন খরিদ্দার পেল রইচ। বেঞ্চিতে বসেছিল একা, কেমন যেন ভাবুক টাইপের। তাকে চা দিয়ে আব্দার করল রইচ, ‘ভাইজান, একটা কতা ছিল।’
‘বলো।’ চায়ে চুমুক দিয়ে বললো যুবক।
‘আমার শালাবাবু বিদেশ থন এই মোবাইলডা পাডাইছে। আপনি যদি এট্টু দেহাইয়া দিতেন ক্যামনে ফোন করে, ক্যামনে ধরে তাইলে ম্যালা উপকার হইত।’ পকেট থেকে মোবাইল বের করতে করতে বললো রইচ।
বোঝা গেল যুবকের হাতে অফুরন্ত সময়। চা খেতে খেতে মন দিয়ে সে রইচকে বুঝিয়ে দিল সবকিছু। কিভাবে কল করতে হয়, কিভাবে রিং বাজলে ফোন ধরতে হয়। কিভাবে মোবাইল বন্ধ করতে হয়। সবকিছু। এই একটা গুণ আছে রইচের। তাকে কেউ কিছু একবার দেখিয়ে দিলেই হলো, সে চট করে ধরে নিতে পারে সেটা, তা সে যত কঠিন কিছুই হোক। মোবাইলটা বন্ধ করে রাখল রইচ। মনে মনে খুশি হলো। এখন আর যখন তখন এটা বেজে উঠবে না।
একটু আগেভাগেই খুপরিতে ফিরে এলো রইচ। মেয়েটার জ্বর দু’দিন ধরে। বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। হাত দিয়ে দেখল গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। কিছুক্ষণ আগে বোধ হয় জরিনা মেয়ের মাথায় সরষের তেল দিয়ে মাথা ধুয়ে দিয়েছে। ছোট ছোট কোঁকড়া কালো চুল লেপ্টে রয়েছে মাথায়, একগোছা এসে পড়েছে মুখের উপর। মেয়ের মুখটা অসম্ভব রকমের লাল, পেটানোর আগে কামারের লোহা যেমন থাকে ঠিক তেমন। রইচ ভুলে গেল পকেটে থাকা দামী মোবাইলটার কথা।
শীতের রাত। রইচ শুয়ে পড়ল রাত দশটার দিকে। ঘুম আসছিল না বলে বিছানায় এপাশ-ওপাশ করছিল। তখনই মনে পড়ল মোবাইলটার কথা। আর মনে পড়তেই তড়াক করে শোয়া থেকে উঠে বসল, হাত চলে গেল পকেটে। জিনিসটা আছে, যেখানে রেখেছিল ঠিক সেখানটাতেই। স্যান্ডেল পায়ে গ’লিয়ে চুপিচুপি বের হতে যাচ্ছিল খুপরি থেকে, তখনই জরিনার কণ্ঠ শুনতে পেল, ‘এতরাতে আবার কই যাও?’
‘ঘুম আহেনা বৌ। এট্টু হাইট্টা আহি।’ বললো রইচ।
বাইরে বেরিয়ে এসে কিছুক্ষণ হাঁটল। তারপর মোবাইলটা চালু করল রইচ। কি সুন্দর চকচকে পর্দা। জিনিসটা আসলেই ভালো। এটা বেচবে না সে কখনও, রেখে দেবে নিজের কাছে। একটা মোবাইল কাছে থাকলে কত সুবিধাই না হয় তার। রাতে ফিরতে দেরি হলে জরিনা একটা ফোন করেই জানতে পারবে কোথায় আছে সে। মেয়েটার ভালোমন্দ কিছু হলে সংগে সংগে জানাতে পারবে। রইচ ভাবছিল এসব। তখনই মোবাইলটা বেজে উঠল। ফোনটা ধরবে কি ধরবে না দোটানায় ছিল রইচ, একসময় ধরে ফেলল, কানে ঠেকাতেই ওপাশে শুনতে পেল একটা নারী কণ্ঠ, ‘বাপজান, তুই বাসায় ফিরে আয়। বাপজান, তুই চুপ করে আছিস কেন? কথা বল, বাপ আমার। তুই বাসায় আয়। আমরা আর কখনও তোকে বকব না। তোর আব্বা বলেছে, সেও আর কখনও বকবে না তোকে। তুই বাসায় চলে আয় বাপ আমার। সারাদিন কিছু খাইছস? আমরা যে তোর জন্যে না খেয়ে আছিরে বাপ। তুই বাসায় ফিরে আয়।’
লাইনটা কেটে দিল রইচ। দূর থেকে ভেসে আসছিল কথাগুলো, কান্নাজড়ানো কণ্ঠ এক মায়ের- যে জানে না এখনও তার সন্তান এখন কোথায় কেমন আছে। রইচের বুকের ভিতর পুড়ছিল কিছু একটা, সেই সাথে জ্বালা ধরাচ্ছিল। এই জীবনে অনেক মার খেয়েছে রইচ। ছোটবেলায় হারু মাষ্টারের বেতের বাড়িতে পিঠে কালসিটে পড়ে গিয়েছিল তার। সে সময়ও এতটা জ্বলেনি কোনদিন। জামেল মোড়লের চাকরের লাথিতে উঠোনে ছিটকে পড়েছিল সেরাতে, একটু ব্যথা পেয়েছিল সেদিন, কিন্তু আজকের এই যন্ত্রণার কাছে তা যেন নস্যি। মৌচাকমোড়ে পকেটমারতে গিয়ে একবার হাতেনাতে ধরা পড়ে গিয়েছিল রইচ। বেদম মার খেতে হয়েছিল সেদিন। ইট দিয়ে ঘা দিয়ে পাবলিক থেতলে দিয়েছিল ওর ডান হাতখানা। তবুও এতটা কষ্ট হয়নি সেদিন রইচের! অথচ আজ? এত কষ্ট হচ্ছে কেন তার!
মোবাইলটা বন্ধ করে রাখল রইচ। হন্তদন্ত হয়ে হাঁটতে লাগল। খুব অল্পক্ষণেই পৌঁছে গেল সেই সিএনজি পাম্পটার কাছে, যার সামনের রাস্তায় এক্সিডেন্টটা হয়েছিল সকালে। এখন পাম্পটা একদমই ফাঁকা। চাদর মুড়ি দিয়ে অল্পবয়সী একটা ছেলে ঢুলছে। তাকেই ধরল রইচ, ‘ভাই, আজ সকালে এইহানে এট্টা এক্‌ছিডেন্ট হইছিল না?’
‘হ। হইছিল।’ মাথা নাড়ল ছেলেটা।
‘পোলাডার কি হইছিল? বাইচ্চা গেছিল?’ জিজ্ঞাসা করল রইচ।
‘না, মইরা গেছিল গা। লাশ পইড়া ছিল দুপুর পন্ত। তারপর পুলিশে লাশ নিয়া গেল।’ ছেলেটা বললো।
‘কই গেল?’ অস্থির দেখাচ্ছিল রইচকে।
‘ঢাকা মেডিকেলে।’ বললো ছেলেটা। ততক্ষণে একটা গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে গ্যাস নেওয়ার জন্য। ছেলেটি ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
রইচ দাঁড়াল না একটুও। উদ্ভ্রান্তের মতো হাঁটতে শুরু করল। একটা গাড়ি কিছুটা স্লো হতেই তাতে উঠে পড়ল লাফ দিয়ে। এই গাড়িটা ঢাকা মেডিকেলের ওই দিকে যায়। রইচ জানে। এই শহরের সব রাস্তা চেনে সে। রাত-বেরাত ঘুরে বেড়ানোর অভ্যেসও রয়েছে অনেক। তার কোন ভয় নেই। ফিকে কুয়াশায় মোড়া শহর। রাস্তা ফাঁকা। গাড়ি চলছে জোরের উপর। মাঘের বাতাস ভাঙা কাচ গ’লে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ছে ভিতরে। সিটে গা এলিয়ে দিল রইচ। মোবাইলটা আবার চালু করল। একটু বাদে রিং বাজতে শুরু করল। বেজে বেজে থেমে গেল একসময়। কিছুক্ষণ বাদে আবার বাজতে শুরু করল। থেমেও গেল তা আবার একসময়। ফোন ধরার শক্তি নেই রইচের।
মেয়ের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠল একবার। তখনই ভুল ভাঙল রইচের। না, এটা মেয়ের মুখ না। এটা তার মায়ের মুখ। মা দাঁড়িয়ে আছে। কবরখানার পাশে। মা’র হাতে কেরোসিনের লণ্ঠন। মা ডাকছে তাকে। ‘বাজান, আমার কাচে আয় বাজান। আমি তোরে কিচ্চু কমুনা। আয় বাজান। এদিকে আয় একবার।’
সারিসারি নিয়ন বাতি যেন জোনাকি পোকা, জ্বলছে কিন্তু নিভছে না। রইচের চোখ জ্বলছে। তার বুকের ভিতরে আগুন। গনগনে আগুন। কিছু আগুন চোখে দেখা যায় না, কিন্তু পোড়ায় ষোল আনা।

Comments

Popular posts from this blog

একটি সাদামাটা প্রেমের গল্প

তোমাকে ঠিক চেয়ে নেব